নৈসর্গিক রূপ আর ইতিহাস ঐতিহ্যের লালনভূমি বানিয়াচং উপজেলা। ভূ-গঠনিক অবনমন ভূমির হাওর-বাঁওড়ে সুশোভিত। অসংখ্য নদ-নদী বিধৌত ও বিল-ঝিল, খাল-নালা অধ্যুষিত এক নয়নাভিরাম সুবর্ণভূমির জনপদ। বর্ষায় হাওরে থৈ থৈ জলরাশির উচ্ছ্বলতা। এরই বুকে দ্বীপের মতো ভেসে থাকা ছোট ছোট পলস্নীর আকুল করা দৃশ্যে কেবলই কাব্যিক ব্যাঞ্জনা। নৌকা বাইচে সারি গানের তালে তালে প্রাণের উচ্ছ্বাসে উদ্ভাসিত এই জল ঢেউ’র দেশ। হেমমেত্ম দিগমত্মজুড়া ফসলের মাঠ। অঘ্রানে আমন ধানের মৌ মৌ গন্ধ আর নবান্নের কলতানে ভাস্বর বাংলার চিরায়ত রূপ। বোরো মৌসুমে চারিদিকে সবুজের সমারোহ। লিলুয়া বাতাসে ধানগাছের কচি ডগার খেলানো ঢেউয়ে দোলে উঠে প্রাণ। বোশেখে সোনালী রঙের রঙিন ধানসিঁড়ি মাঠ জুড়িয়ে দেয় হৃদয়। ফসল কাটার আনন্দ পরিণত হয় মহাউৎসবে। ‘‘গোলায় ধান, জলায় মাছ ও গলায় গান’’ এ নিয়েই হাওর পাড়ের নিরমত্মর জীবনযাত্রা। সংগ্রামী জীবনের বৈশিষ্ট্য এবং বৈচিত্তে রসবোধের মহিমা ও উৎকর্ষতা।
বানিয়াচংয়ের আবহমান কালের লোকজ জীবনধারার উপাখ্যান বা লোকগাঁথা বাংলা লোকসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। আইড়ি (আরি), আন্নি, ঘাটু ও পালা গানের মতো প্রাচীণ লোকগানের সৃষ্টি এ অঞ্চল থেকেই। এছাড়া মালজোড়া (গানের লড়াই), বাউল, মারফতি, মুর্শিদী, দেহতত্ত্ব, বিচ্ছেদীসহ জারি, সারি, গীত, ধামাইল ও ভাটিয়ালি গান এতদাঞ্চলের মরমী গায়ক ও সাধক এবং কবিদের সৃষ্টি। কেচ্ছা-কাহিনী, প্রবাদ-প্রবচন, শোয়াইয়া, ছিলোক বা ধাঁধাঁ রচনা ও চর্চায় শেকড়ের সন্ধান মিলে। ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের ‘‘মৈমনসিংহ গীতিকা’’, অচ্যুত চরণ চৌধুরীর ‘‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত’’, আশরাফ হোসেন সাহিত্যবিশারদের ‘‘সিলহটের ইতিহাস’’, গোলাম রহমানের ‘‘বানিয়াচং দর্পন’’, শেখ ফজলে এলাহির ‘‘বানিয়াচং বৃত্তামত্ম’’, শফিউদ্দিন সরকারের ‘‘বারো ভূঁইয়ার উপাখ্যান’’ এবং প্রাচীন রচনা পদ্মনাথ স্বরসতীর ‘‘বাহ্মণ সমাজ’’ ও মুঘল সম্রাটের সেনাপতি মির্জা নাথানের ‘‘বাহারীস্থান-ই-গায়েবী’’ গ্রন্থ থেকে বানিয়াচং ও লাউড় রাজ্যের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও লোকসাহিত্য সংস্কৃতির বিসদ বর্ণনায় অজানাকে জানার সুযোগ করে দিয়েছে।
প্রাচীণ জনপদ বঙ্গ অমত্মর্ভুক্ত ‘পূর্ব বাঙালার’ এই হাওর বা ভাটি এলাকা নিয়ে ÿুদ্র রাজ্য গড়ে উঠেছিল। রাজধানী ছিল বানিয়াচং। রাজা, জমিদার ও জায়গীরদারদের শাসনকাল ও বীরত্বগাঁথা ইতিহাসের পাতায় বিধৃত। অনেক প্রাচীন নিদর্শণ ও পুরাকীর্তি এখনও বিদ্যমান। চারশ থেকে পাঁচশ বছরের প্রাচীন মসজিদ, মন্দির, রাজবাড়ীর ধংসাবশেষ, বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীর আখড়াগুলো কালের সাÿী হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ‘সাগর দিঘী’তে দর্শনার্থীদের ভীড় ও একে ঘিরে রাণী কমলাবতীর আত্মবিসর্জনের উপাখ্যাণ এখনো মানুষের মুখে মুখে ফিরে। পলস্নীরাজ বা মহাগ্রাম নামে ভূষিত পৃথিবীর বৃহত্তম গ্রাম বানিয়াচং পর্যটকদের হাতছানি দেয়। সারি সারি বৃÿরাজি ও প্রাচীন বসতির নিদর্শন মাটির ঢিবি ও টিলায় ঝোঁপ-ঝাড় ও জঙ্গল যেন অতীতের কথা কয়। গ্রামের অভ্যমত্মরে এuঁকuঁবকে বয়ে গেছে সুনারম্ন ও গড়ের খাল। বর্ষায় জলে টইটম্বুর হয়ে গ্রামের শ্রী ছবির মতো ভেসে উঠে। অসংখ্য ও দিঘীগুলোর পাড় ধরে মহলস্না ও পাড়ার নান্দনিক অবস্থান আগন্তুকদের দারম্ননভাবে আকর্ষন করে। জানার আগ্রহে আরো কাছে টেনে নেয় গ্রামীণ ঐতিহ্য। কালজয়ী উপাখ্যান আলাল-দুলাল, রাণী ভবানী, আমেনা সুন্দরী, আফজাল খান ও আরজু বানুর স্মৃতি বিজড়িত এই কিংবদমত্মীর বানিয়াচং। প্রাচীন জনপদ, হাওর
বাঁওড়, পাখ-পাখালী আর ফলফসলে ভরপুর প্রকৃতির এই লীলভূমি গর্বিত বাংলার প্রতিচ্ছবি। পর্যটক ও দর্শনার্থীদের মোহিত করার মতো বৈচিত্রময় লৌকিক সম্ভার।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস